নেহেরু রিপোর্ট(১৯২৮)

১৯২৭ সালের নভেম্বরে, ব্রিটিশ সরকার ভারত সরকার আইন ১৯১৯ এর কার্যকারিতা পর্যালোচনা করতে এবং ভারতের জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য সাইমন কমিশন নিয়োগ করে। ভারতের সংবিধান রচনা করার উদ্দেশ্যে গঠিত এই কমিশনে কোনো ভারতীয় সদস্য স্থান পাননি। তা ছাড়া এই কমিশন গঠনকালে ভারত সচিব বার্কেনহেড (১৯২৪-২৮ খ্রি.) সংবিধান রচনার বিষয়ে ভারতীয়দের যােগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তােলেন। এসব ঘটনায় ভারতীয়রা অত্যন্ত অপমানিত ও ক্ষুধ হয়ে যােগ্য জবাব দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে মাদ্রাজ অধিবেশনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নেয় ভারতের সংবিধান রচনা করার জন্য সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করা হবে। মুসলিম নেতা এম. এ. আনসারির নেতৃত্বে দিল্লিতে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির ওপর ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

কমিটির অন্যান্য সদস্য এই কমিটির সম্পাদক হন তরুণ নেতা জওহরলাল নেহরু । বিভিন্ন দল থেকে নির্বাচিত এই কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন কংগ্রেস থেকে সুভাষ চন্দ্র বসু , মুসলিম লীগ থেকে আলি ইমাম ও সাহেব কুরেশি , হিন্দু মহাসভা থেকে এম. এস. অ্যানে ও এম. আর. জয়াকার , শিখ সম্প্রদায়ের সর্দার মঙ্গল সিং প্রমুখ ।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে লক্ষ্মৌতে সর্বদলীয় সন্মেলনের পূর্ণ অধিবেশনে নেহেরু কমিটির প্রধান মতিলাল নেহেরু ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের প্রস্তাব দিয়ে সংবিধানের একটি খসড়া পেশ করেন । এই খসড়া সংবিধানই নেহেরু রিপোর্ট নামে পরিচিত ।

নেহেরু রিপোর্ট এর শর্ত বা ধারা

  • ভারতকে পূর্ণ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা দিতে হবে ।
  • ভারতকে একটি যুক্তরাষ্ট্রের রূপ দিতে হবে যার প্রধান ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় আইনসভার হাতে ।
  • কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ দুই কক্ষ বিশিষ্ট হতে হবে ।
  • প্রদেশগুলিতে এক – কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গড়ে তুলতে হবে ।
  • ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন করতে হবে ।
  • প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতে ( পাঞ্জাব ও বাংলা বাদে ) জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের ১০ বছরের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখতে হবে ।
  • সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্ম , ভাষা ও সংস্কৃতির নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে ।
  • ভারতবাসীর ১৯ টি মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব নিতে হবে ।
  • কেন্দ্র ও প্রদেশগুলিতে দায়িত্বশীল সরকার গড়ে তুলতে হবে ।
  • সর্বোচ্চ আদালত গঠন করতে হবে।
  • সাম্প্রদায়িক ভােটাধিকারের নীতি ত্যাগ করে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সার্বজনীন ভোটাধিকার নীতি গ্রহণ করতে হবে ।

বিভিন্ন দলের প্রতিক্রিয়া

  • জাতীয় কংগ্রেস নেহেরু রিপোর্টকে সানন্দে গ্রহণ করলেও কিছু তরুণ সদস্যও ভিন্নমত পোষন করেছিলেন। নেহেরু রিপোর্ট dominion status দাবী করেছিল অন্যদিকে তরুণ ব্যক্তিবর্গ পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেন ।
  • জিন্নাহ হিন্দুদের সঙ্গে আপস রফার জন্য অধিকাংশ মুসলমান নেতাকে কয়েকটি শর্তে পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা পরিত‍্যাগ করে যৌথ নির্বাচনী ব্যবস্থা মেনে নিতে রাজি করান । কিন্তু মতিলাল নেহেরু হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দের চাপে মহম্মদ আলী জিন্নাহর অধিকাংশ দাবি অগ্রাহ্য করেন । তখন মহম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের কট্টর গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলান ও ১৪ দফা দাবির (Fourteen Points) কথা ঘোষণা করেন ।
  • শুধু মুসলিম লীগই নয় ব্রিটিশ সরকার শিখ ও খ্রিষ্টানরা, মাদ্রাজের অব্রাহ্মণ দল, ডঃ আম্বেদকরের অনুন্নত গোষ্ঠী প্রভৃতি নেহেরু রিপোর্ট এর বিরোধিতা করেছিল ।
  • মূলত মহম্মদ আলী জিন্নাহ ও হিন্দু মহাসভার গোয়ার্তুমি নেহেরু রিপোর্টের ভরাডুবির জন্য দায়ী ছিল ।

জিন্নার ‘চোদ্দো দফা দাবি'

মহম্মদ আলি জিন্নার সভাপতিত্বে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে (২৮ মার্চ) দিল্লিতে মুসলিম লিগের অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে জিন্না ভারতের মুসলিমদের স্বার্থে তাঁর বিখ্যাত 'চোদ্দো দফা দাবি' (Fourteen Points) পেশ করেন।চোদ্দো দফা দাবি-সমূহ: মহম্মদ আলি জিন্নার চোদ্দো দফা দাবিগুলি ছিল一

  1. ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন।
  2. প্রদেশগুলিতে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন।
  3. আইন সভাগুলিতে মুসলিমদের যথেষ্ট সংখ্যক প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযােগ দান।
  4. মুসলিমদের জন্য কেন্দ্রীয় আইনসভায় ১/৩ অংশ আসন সংরক্ষণ।
  5. মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
  6. বাংলা, পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রেখে ভারতের প্রদেশগুলির পুনর্গঠন।
  7. সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ধর্মীয় স্বাধীনতা দান।
  8. কোনাে আইনসভার কোনাে সম্প্রদায়ের ৩/৪ অংশ সদস্য কোনাে বিলের বিরােধিতা করলে তা প্রত্যাহার।
  9. প্রাদেশিক আইনসভার অনুমতি ছাড়া সংবিধান পরিবর্তন না করা।
  10. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভায় ১/৩ অংশ মুসলিম সদস্য গ্রহণ করা।
  11. রাজ্য ও স্থানীয় সংস্থাগুলিতে মুসলিমদের জন্য পদ সংরক্ষণ করা।
  12. সিন্ধু প্রদেশকে বােম্বাই প্রদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নতুন প্রদেশ গঠন করা।
  13. বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সাংবিধানিক সংস্কার প্রবর্তন।
  14. মুসলিম শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ।

রাজাজি সূত্র বা সি. আর. ফর্মুলা

  • ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়াে আন্দোলনের সময়ও মুসলিম লিগের অনড় দাবি ছিল পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠন।
  • এই অবস্থায় স্বাধীন ভারতকে দ্বিখণ্ডিত না করে, অথচ জিন্নার দাবির কিছু অংশ বাস্তবায়িত করে গান্ধি অনুগামী মাদ্রাজের চক্রবর্তী রাজাগােপালাচারী এক সমাধানসূত্র প্রকাশ করেন (মার্চ, ১৯৪৪ খ্রি.)। তার এই সমাধানসূত্র 'রাজাজি সূত্র' বা সি. আর. ফর্মুলা (C. R. Formula) নামে পরিচিত।

প্রস্তাবসমূহ:

  • কংগ্রেসের স্বাধীনতার দাবিকে মুসলিম লিগ পূর্ণভাবে সমর্থন করবে এবং কংগ্রেসের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবে।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞলের অধিবাসীদের গণভােট গ্রহণ করে দেখা হবে যে তারা পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষপাতী কিনা।
  • গণভােট গ্রহণের আগে সব দলকে তাদের বক্তব্য প্রচারের সুযােগ দেওয়া হবে।
  • মুসলিম-প্রধান অঞ্চলগুলি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে মত দিলে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠিত হবে। দেশভাগ হলেও প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, যােগাযােগ ও অন্যান্য বিষয়ে উভয় অংশই সমানভাবে জড়িত, এইসব বিষয় যৌথভাবে পরিচালিত হয়।
  • ব্রিটিশ সরকার ভারতকে স্বাধীনতা দিলে তবেই এই প্রস্তাব কার্যকরী হবে।

প্রস্তাবের ব্যর্থতা:গান্ধিজি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে জেল থেকে ছাড়া পান। এরপর তিনি রাজাজির প্রস্তাব অনুসারে ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বােম্বাইয়ে জিন্নার বাসগৃহে ২১ বার বৈঠক করেন। কিন্তু জিন্না বিভিন্ন কারণে রাজাজি সূত্র প্রত্যাখ্যান করেন।